মাদারীপুরে গরীবের ডাক্তার খ্যাত মশিউর রহমান এক যুগ ধরে সেবা দিয়ে আসছেন
মাদারীপুর
ম্যালা (অনেক) দিন ধইর্যা ডায়বেটিকস হইছে। ডাক্তার দেখাইছিলাম একবার। টাহ্যা (টাকা) নাই বলইলা আর ডাক্তার দেহাইতে (দেখাতে) পারি নাই। এহন ম্যালা অসুস্থ। তাই একজন কইলো এইহানে একজন ডাক্তার আছেন। তিনি নাকি টাহ্যা (টাকা) না দিলেও দেহেন। আবার নাকি ওষুধও দিয়া দেন। তাই আইছি এইহানে। ডাক্তারও দেহাইছি। টাহ্যা লাগে নাই। উল্টো ওষুধ কিনতে টাহ্যা দিছে। আল্লাহই তার ভালা করুন। এভাবেই কথাগুলো বললেন মাদারীপুর সদর উপজেলার মহিষেরচর থেকে আসা ৬০ বছরের সোলেমান বেপারী।
শুধু তিনি নন, এমন কথা বলেন অনেক রোগী। শুধু রোগীরা নন, ডাক্তারের চেম্বারে একটু সহযোগিতার জন্য অনেক অসহায় গরীব দুঃস্থ মানুষকেও দেখা যায়। তারা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে ডাক্তারের কাছ থেকে সহযোগিতা নেন। এমন একজনের সাথে কথা হয়।
নাম রিয়াদ হোসেন। মাদারীপুর সরকারী কলেজে এবার একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, আমি কলেজে টাকার জন্য ভর্তি হতে পারছিলাম না। তখন এই ডাক্তার আমাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তাই তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তিনি টাকা না দিলে হয়তো কলেজে ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে যেতো।
বেশ কয়েকদিন আগে ঐ ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখা যায়, একজন বয়স্ক লোক খুব সহজেই স্বাভাবিকভাবে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়লেন। গায়ে তার ছেড়া ময়লা শার্ট, শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। ডাক্তার তখন রোগী দেখছেন। ঐ লোকটিকে ঢুকতে দেখে ডাক্তার রাগ না হয়ে তাকে বললেন কি চান? লোকটি বললেন আমার মেয়ের বিয়া। একটু সাহায্য চাই। ডাক্তার তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, কয় দিন আগে মেয়ের বিয়ের কথা বলে টাকা নিলেন, আবার কোন মেয়ের বিয়ে। কথাটা শুনে লোকটির মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বলে না মানে তহন বিয়া হয় না। এখন হইবো। তবুও ডাক্তার তাকে রাগ না করে একটু হেসে বলেন, মিথ্যা কথা ছেড়ে, কাজ করে বাচো, তাতেই সম্মান। এই বলে সে পকেট থেকে ৫০০ টাকা বের করে বলেন, যাও আর মিথ্যা বলবে না। কাজ করো। কাজ করতে যদি কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হয় এসো। সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। এভাবেই কথাগুলো বললেন মাদারীপুর শহরের সুস্থ নগরি নামে স্থানীয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের ডাক্তার মো. মশিউর রহমান।
খুব অল্প সময়ে মাদারীপুরের সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছেন ডা. মো. মশিউর রহমান। তার সুন্দর ও অমায়িক ব্যবহারে রোগীরা খুশি। তাছাড়া যে যা পারেন তাই দিয়ে দেখেন রোগী। বেশির ভাগ রোগীই টাকা দেননা। তবুও তিনি হাসি মুখে রোগীদের সাথে কথা বলেন। আবার কোন কোন সময় বিনা টাকায় রোগী দেখার পর উল্টো ওষুধ কেনার জন্য টাকাও দেন। তাই শহরজুড়ে তার সুনাম রয়েছে। ইতিমধ্যে তাকে অনেকেই গরীবের ডাক্তার বলে চিনেন।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুলপদ্বি এলাকার অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন ও গৃহিনী মাসুদা খানমের বড় সন্তান ডাক্তার মশিউর রহমান। বর্তমানে তিনি ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশন নড়াইলে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০০৮ সালে এমবিবিএস পাস করার পর ২০০৯ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি শুক্রবার মাদারীপুরের সুস্থ নগরি নামে একটি স্থানীয় ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন।
এছাড়াও করোনার মহামারি সময়েও তিনি রোগী দেখেছেন। যখন বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ দেখা যায় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডাক্তার বসছেন না, বা রোগী দেখছেন না। তখনও তিনি রোগী দেখেছেন। দুবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। তবুও থেমে যাননি। সুস্থ হয়ে আবার রোগী দেখেছেন।
এ ব্যাপারে সাংবাদিক আয়শা সিদ্দিকা বলেন, করোনার মহামারির সময়ে আমি আমার মাকে নিয়ে তার কাছে যাই। বলি আম্মুর কিন্তু জ্বও আছে। তখনও তিনি কোন দ্বিধা বোধ করেননি। স্বাভাবিকভাবে দেখেছেন।
এ ব্যাপারে ডা. মশিউর রহমান বলেন, আমি চেম্বারে রোগী দেখতে বসলে, কারো কাছ থেকে চেয়ে টাকা নেইনা। যে যা দেন, তাই নেই। আর যে রোগীরা টাকা দিতে পারেন না। তাদের বিনা টাকায় দেখি। অনেক সময় ওষুধও কিনে দেই। আসলে মানুষকে সেবা করাই মানবতা। যতদিন বেচে আছি ততদিনই মানুষকে সেবা করে যেতে চাই।
মাদারীপুরের স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন নকশি কাথার সদস্য কেএম জুবায়ের জাহিদ বলেন, আসলে এই ডাক্তারের কথা সবার মুখে মুখে শোনা যায়। বর্তমানে ডায়াবেটিকস রোগীর সংখ্যা বেশি। গরীব রোগীরা টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে পারেন না। তাই সেই সব রোগীরা তার কাছেই ভীর করেন বেশি। সমাজে তার মতো ডাক্তার আরো প্রয়োজন।
মাদারীপুর
২৩-০৪-২০২২
Leave a Reply